ভাত খাবার সময় বা খাবার ঠিক পরপরই পানি পান করা উচিত নয়, এ রকম একটি কথা চালু আছে। আবার অনেকের মতে, ভাত খাওয়ার সময় একটু পানি পান করাই যায়। এতে কোনো ক্ষতি নেই। আসলে কোনটি সঠিক?
খাবার খাওয়ার
সময় পানি পান করা উচিত নয়। এর পেছনের ব্যাখ্যাটি হচ্ছে খাবার খাওয়ার সময়, ঠিক আগে বা
পরে পানি পান করলে তা পাচক রসকে পাতলা করে দেয়। এটি খাদ্যের সঠিক ভাঙ্গনে হস্তক্ষেপ
করে যার ফলে খাদ্য হতে পরিপূর্ণ পুষ্টি শোষণের প্রক্রিয়া ব্যাহত হয়।
কিন্তু এর বিপরীতেও
জোরালো মতবাদ রয়েছে। যেমন যুক্তরাষ্ট্রের একজন নিবন্ধিত ডায়েটিশিয়ান তামারা ডুকার
ফ্রেউম্যান যিনি "দ্যা ব্লোটেড বেলি
হুইস্পার" এর লেখক তার মতে তত্ত্বটি মিথ্যা। এটাও জানা যায় যে প্রভাবটা অনেকটা
নির্ভর করে কত গতিতে এবং কি পরিমান পানি পান করা হচ্ছে তার উপরও।
স্বাস্থ্য সম্পর্কিত
অনেক ভুল তথ্যের মতো, খাবারের সাথে পানি পান করার বিরুদ্ধে যুক্তিটিও যুক্তিযুক্ত বলে
মনে হয়, তবে তা আমাদের শরীর কীভাবে কাজ করে তার একটি এুটিপূর্ণ ব্যাখ্যার উপর ভিত্তি
করে।চলুন আগে দেখি আমাদের হজম ক্রিয়া কিভাবে কাজ করে: মূলত হজম ক্রিয়ার শুরু আমাদের
মুখ থেকেই। চিবানোর মাধ্যমে খাবার ছোট ছোট টুকরায় পরিণত হয় এবং নরম হয় আর রাসায়নিক
প্রক্রিয় শুরু হয় আমাদের লালায় থাকা এনজাইম ঐ খাবারের সাথে মিশ্রিত হওয়ার মধ্য দিয়ে।
তারপর খাদ্য খাদ্যনালী দিয়ে পাকস্থলিতে চলে যায়, পাকস্থলিতে গ্যাস্ট্রিক এসিড খাদ্যকে
ভাঙে। এরপর তা চলে যায় ক্ষুদ্রান্ত্রে, যেখানে এটি পিত্ত অ্যাসিড এবং এনজাইমের সাথে
মিলিত হয়। এই পর্যায়ে প্রায় ৭৫ শতাংশ পুষ্টি শোষণ ঘটে। এ পর্যায়ে যে পদার্থ গুলো
শোষিত হয়নি তা বৃহদন্ত্রে প্রক্রিয়াজাত করা হয় এবং পরবর্তীতে তা মলের মাধ্যমে নির্গত
হয়। পুরো প্রক্রিয়াটি ঘটতে ২৪ থেকে ৭২ ঘন্টার মতো সময় লাগে।
পানি পাকস্থলীর
পাচক রসকে পাতলা করে দেবে এমন ধারণাটি বিভিন্ন কারণে ভুল। প্রথমত, পেটে পানি শোষিত
হয় বেশ দ্রুত – সাধারণত প্রায় ২০ মিনিটের মধ্যে। এর মানে হল যে কোন সম্ভাব্য তরলীকরণ
ক্ষণস্থায়ী হবে। তবে "যদিও পেট ভরে পানি পান করা হয়, তবেও এটি খাবারের হজমে হস্তক্ষেপ করবে না," বলেন
ডেবোরা ডি. প্রক্টর যিনি আমেরিকান গ্যাস্ট্রোএন্টারোলজিকাল অ্যাসোসিয়েশনের গভর্নিং
বোর্ড সদস্য। পানি এনজাইমের কার্যকলাপকে বাধা দেবে না, তিনি বলেন, কারণ "এনজাইমগুলি
পানির উপস্থিতি উপেক্ষা করে খাদ্য কণার সাথে ক্রিয়া করবে।"
ফ্রেউম্যানের
মতে "পানি পেটের অম্লতাকে প্রভাবিত করবে না।" যখন কোন কিছু খাওয়া হয় সেটা
খাবার বা পানীয় যাই হোক, তা তাৎক্ষণিক পাকস্থলীর পরিবেশকে কিছুটা অম্লীয় করে তুলে,
অ্যাসিডের মাত্রাটা নির্ভর করে খাবার টা হজম হতে কি পরিমাণ অ্যাসিডিক পরিবেশ প্রয়োজন
তার উপর। পুরো সিস্টেমটি এভাবেই ডিজাইন করা। তিনি বলেন "বিষয়টি এমন না যে আপনার
শরীর একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ অ্যাসিড দিয়ে কাজ শুরু করবে এবং এটি দিয়েই শেষ করতে হবে।
যদি আপনার আরও প্রয়োজন হয় আপনার শরীর আরও তৈরি করবে।"
পাকস্থলী থেকে
খাবার বের হয়ে ক্ষুদ্রান্ত্রে যাওয়ার গতিকে পানি ধীর করে দেয় এই বিশ্বাসটি বিজ্ঞানের
সাথে সাংঘর্ষিক। বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে যে, খাবারের সাথে পানি পান করা আপনার পেট
কত তারা তারি খালি হবে তার হারের সাথে সম্পর্কিত নয় এবং আপনার পাকস্থলী একটি পানযোগ্য
খাবার যেমন স্মুদি এবং একটি সাধারণ শক্ত খাবার যা খাওয়ার সময় সাথে তরল কিছু পান করা
হয়েছে এর মধ্যে কোন পার্থক্য করে না। উভয়ই হজম হতে একই সময় নেয়।
খাবারের সময়
পানি পান করা আসলে হজমে সাহায্য করতে পারে, বিশেষ করে চিবানো এবং গিলে ফেলার পর্যায়ে,
যেখানে এটি খাবারকে নরম করতে এবং খাদ্যনালী দিয়ে খাবার যেতে সাহায্য করতে পারে। সাধারণভাবে
হাইড্রেটেড থাকলে তা হজম প্রক্রিয়ায় সাহায্য করে — মলকে নরম রাখতে এবং অন্ত্রের মধ্য
দিয়ে চলতে সাহায্য করে।
খাওয়ার আগে
পানি পান করার একটি উপকারিতা হচ্ছে এটি সাময়িক ভাবে আপনার পেটকে কিছুটা ভরিয়ে দেয়(মনে
রাখবেন, এটি প্রায় ২০ মিনিটের মধ্যে শোষিত হয়)। এটি খাবারের সময় তুলনামূক কম খাবারে
পেট ভরাতে সাহায্য করবে। এর প্রভাব কি ইতিবাচক হবে নাকি নেতিবাচক তা নির্ভর করবে আপনার
দৃষ্টিভঙ্গির উপর। আপনি যদি ওজন কমাতে চান, গবেষণায় দেখা গেছে যারা খাবার আগে ১১/২ থেকে ২ কাপ পানি
পান করে তারা তুলনামূলক কম খাবার খায়। তবে এটি কিছু ক্ষেত্রে আপনার প্রয়োজনীয় পুষ্টি
গ্রহনে বাধা সৃষ্টি করতে পারে। আরেকটি সম্ভাব্য নেতিবাচক দিক হলো এই পেট ভরে যাওয়া
অনেকের ক্ষেত্রে পেট ফুলে যাওয়া ও অস্বস্তি বোধ সৃষ্টি করতে পারে।
আপনি যদি খাবার
খাওয়ার সময় পানি পান করতে চান, সেটা হোক অল্প খাবারে পেট ভরাতে বা আপনার তৃষ্ণা মেটাতে,
ফ্রেউম্যানের মতে আপনার ধীরে ধীরে চুমুক দিয়ে
পানি পান করা উচিত। তাড়াহুড়া করে পানি পান করলে তা আপনাকে পানির সাথে কিছুটা বাতাসও
গিলে ফেলতে বাধ্য করে যার ফলে পরবর্তীতে পেট ফোলা ফোলা ভাব বা গ্যাস জনিত সমস্যা দেখা
দিতে পারে।
পরিশেষে বলা
যায় আপনি খাবার আগে বা পরে এবং খাবার খাওয়ার সময় যতটা খুশি পানি পান করতে পারেন হজমে
এর কোন খারাপ প্রভাব পরবে না - যতক্ষণ আপনি তা ধীরে ধীরে গ্রহণ করছেন।